ঢাকা , শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশজুড়ে সমালোচনা ঝড়: বাংলাদেশের আইন কি বলে?

  • প্রতিবেদক:
  • আপডেট টাইম ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৪
  • ৭ ভিউ

জেলে যাওয়ার আগে বাবা মোতালেব মৃধার সাথে ছেলে নাজমুল মৃধা।

‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’

‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’ শিরোনামে গত ১৪ জানুয়ারি রবিবার প্রকাশিত একটি সংবাদ সারা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়, যা এই তিনদিন যাবৎ ‘টক অব দ্যা কান্ট্রিতে’ পরিনত হয়েছে। দেশের সকল গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদটি নিয়ে তোলপাড় নেটিজেনরা। ঘটনাটি পটুয়াখালীর মিজার্গঞ্জ উপজেলার পশ্চিম সুবিদখালী গ্রামের। সংবাদটি ঘিরে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। ইতোমধ্যে ওই সংবাদটিকে কেন্দ্র করে বিবৃতি দিয়েছেন (হাইকোর্ট)। এমনকি এক সপ্তাহের মধ্যে করা হবে রিট আবেদন এমনটাও জানিয়েছেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কায়সার কামাল। আসামীদের ডান্ডবেড়ি পরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের আইনে কি আছে? কিংবা এর সাংবিধানিক বিধান কি? এ নিয়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখা দিয়েছেন হাইকোর্টের আরো বেশ কয়েকজন আইনজীবী। তাদের মতে, আসামীদের ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর বিধান থাকলেও পটুয়াখালীতে যেটি করা হয়েছে তাতে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এদিকে ঘটনাটি ঘিরে চরমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই ছাত্রদল নেতা নাজমুল মৃধা বড় ভাই রাসেল মৃধা।

হাইকোর্টের বিবৃতি: পটুয়াখালীর ঘটনাটি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হলে আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো নিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে আমরা হয়তো আনসিভিলাইজড (সভ্য নয়) হিসেবে পরিচিত হব। ‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি নজরে আনা হলে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত সোমবার এ মন্তব্য করেন। গত রবিবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি নজরে এনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার আরজি জানান আইনজীবী কায়সার কামাল। আদালত বলেন, ‘আমরা দেখেছি।’ তখন কায়সার কামাল বলেন, একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্র দিন দিন নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করছে। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়েছি। বেঞ্চ আদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি প্রক্রিয়া বজায় রাখার আগে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করতে বলেছেন। পটুয়াখালীর ওই ঘটনা নিয়ে চলতি সপ্তাহে নতুন করে রিট আবেদন করা হবে।’

সেদিন যা ঘটেছিলো, যে কারনে এত সমালোচনা: স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গত ১৯শে ডিসেম্বর গভির রাতে মো. নাজমুল মৃধাকে তার বাড়ি থেকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাকে একটি পুরাতন বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠায় আদালত। গত শুক্রবার রাতে নাজমুলের পিতা মোতালেব হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশালের একটি হাসপাতালে মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নিতে আইনজীবীর মাধ্যমে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করে নাজমুলের পরিবার। পরে তাকে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন আদালত। যে কারণে জানাজার নির্ধারিত সময়ের আগেই সংক্ষিপ্ত একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পিতা মোতালেব হোসেনের। প্রথম জানাজায় অংশগ্রহণ শেষেই পটুয়াখালী কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় নাজমুলকে। পরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয় তার পিতার মরদেহ। গত শনিবার মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী গ্রামে জানাজায় অংশ নেন নাজমুল। সেই জানাজায় অংশ নেওয়ার কিছু ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায়ই জানাজায় অংশ নেন ঐ যুবক। এসময় তার হাতকড়া খুলে দেয়া হলেও ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। ডান্ডাবেড়ি পরে জানাজায় অংশগ্রহণ করেও বাবার কবরে এক টুকরো মাটি দিতে পারেনি ওই ছাত্রদল নেতা। যার ফলেই দেশজুড়ে ঘটনাটি ঘিরে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

সাংবিধানিক আইন, বিধি ও আইনজীবীদের মতামত: ডান্ডাবেড়ি কোন ধরনের আসামীদের কেনো পরানো হয়, এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন ও বিধান নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন হাইকোর্টের একাধিক আইনজীবী তাদের জানানো মতামত অনুযায়ী (ডান্ডাবেড়ি যাদের পরানো হয়)— বাংলাদেশ জেল কোডের ১৯ নম্বর অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী কারাগারের অভ্যন্তরে ‘কারা অপরাধের’ জন্য গুরুতর শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানোর আদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে তবে এই শাস্তি আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিচারাধীন মামলার আসামি বা রাজবন্দীদের এ ধরনের দণ্ড দেয়ার কোনও বিধান নেই। জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ খেয়াল খুশিমতো বিচারাধীন বন্দি এবং আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরালে তা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন হবে বলেও জানাচ্ছেন আইনজীবীরা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আইনজীবীরা আরো জানান, আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতীত কাউকে কোনও ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না। আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, যে সমস্ত আসামিদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা শৃঙ্খলা জড়িত এবং যাদের মুভমেন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ আছে এবং যারা ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’, অর্থাৎ সুযোগ পেলে পালিয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রেই কেবল ডান্ডাবেড়ি পরাতে হয়। পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন,‘পটুয়াখালীর এই ঘটনাটি মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও ঘৃণিত এবং তাকে সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবেও চরম হেনস্থা করা হয়েছে। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।’
আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন,‘খুব যদি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী থাকে। তাদের জন্য ডান্ডাবেড়ি ছাড়া উপায় থাকে না। যাদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের এলিগেশন থাকে তাদেরকে ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়। তবে সেই ক্ষেত্রেও মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন,‘যে ফৌজদারি আইন আছে, সেটা হয়েছিলো সিপাহী বিদ্রোহের পরে। লক্ষ্য ছিলো সিপাহীদের দমন করা, এবং ভারতীয়দের সোজা রাস্তায় রাখা।’ তিনি আরো বলেন, এত বছর পরও সেই আইন এখনো প্রচলিত আছে এবং যারা আইন প্রণেতা হয়েছেন তারা যে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে সচেতন নন এবং এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেন নাই এটা দু:খজনক।

যা বললেন পরিবার: ছাত্রদল নেতা নাজমুলের বড় ভাই রাসেল মৃধা বলেন, নাজমুল এমন কোনো মামলার দন্ডপ্রাপ্ত আসামী না যে তাকে বাবার জানাজা পড়াকালীন ডান্ডবেড়ি পরিয়ে রাখা হবে। তাছাড়া তাকে যে মামলায় আসামী করে গ্রেফতার করে জেলা হাজতে পাঠানো হয়েছে তার সাথে নাজমুলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুধু বিএনপির রাজনীতি করি বলেই আজ এমন মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে হলো, বাবার কবরে এক টুকরো মাটিও দিতে পারেনি ছোটভাই নাজমুল। তার আগেই তাকে আবার জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। নাজমুলকে জাতীয় নিবার্চনের কয়েকদিন আগে গভীর রাতে পুলিশ বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জানতে চাইলে পুলিশ বলেন উপরের নির্দেশ। এ ঘটনার পরই বাবা বেশি অসুস্থ হয়ে পরে। আমার বাবাও বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল করা কি অপরাধ? আমরা তো রাজনীতি করি, সন্ত্রাস না। ছাত্রদল নেতা নাজমুলের মা রেবা বেগম বলেন, স্বামী কবরে, ছোট ছেলেটা জেলে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিবা হতে পারে। একজন মা জানে এটি কতটা কষ্টের। স্বামীর জানাজায় ছেলে আসলো তাও লোহার ডান্ডবেড়ি পরা। এমনকি দাফনের আগেই আবার ছেলেটাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবার কবরে এক টুকরো মাটিও দিতে পারলো না ছেলেটা। এ কেমন নোংরা রাজনীতির খেলা, এ কেমন আইন।
পটুয়াখালী পুলিশ সুপার সাইদুল ইসলাম বলেন,‘জেলখানা থেকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থাতেই দেওয়া হয়েছিলো। ওটার চাবি বা লক সিস্টেম সেটা আমাদের কাছে কখনোই থাকে না। এটা থাকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। ওরা যেভাবে আমাদের কাছে দিয়েছে সেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধুমাত্র নিরাপত্তা দেয়া। আমরা শুধু সেই নিরাপত্তাই দিয়েছি। ওরা আমাদের যেভাবে দিয়েছে, তাকে সেভাবেই পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ট্যাগ

মন্তব করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল

দেশজুড়ে সমালোচনা ঝড়: বাংলাদেশের আইন কি বলে?

আপডেট টাইম ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৪

‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’

‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’ শিরোনামে গত ১৪ জানুয়ারি রবিবার প্রকাশিত একটি সংবাদ সারা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়, যা এই তিনদিন যাবৎ ‘টক অব দ্যা কান্ট্রিতে’ পরিনত হয়েছে। দেশের সকল গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদটি নিয়ে তোলপাড় নেটিজেনরা। ঘটনাটি পটুয়াখালীর মিজার্গঞ্জ উপজেলার পশ্চিম সুবিদখালী গ্রামের। সংবাদটি ঘিরে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। ইতোমধ্যে ওই সংবাদটিকে কেন্দ্র করে বিবৃতি দিয়েছেন (হাইকোর্ট)। এমনকি এক সপ্তাহের মধ্যে করা হবে রিট আবেদন এমনটাও জানিয়েছেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কায়সার কামাল। আসামীদের ডান্ডবেড়ি পরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের আইনে কি আছে? কিংবা এর সাংবিধানিক বিধান কি? এ নিয়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখা দিয়েছেন হাইকোর্টের আরো বেশ কয়েকজন আইনজীবী। তাদের মতে, আসামীদের ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর বিধান থাকলেও পটুয়াখালীতে যেটি করা হয়েছে তাতে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এদিকে ঘটনাটি ঘিরে চরমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই ছাত্রদল নেতা নাজমুল মৃধা বড় ভাই রাসেল মৃধা।

হাইকোর্টের বিবৃতি: পটুয়াখালীর ঘটনাটি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হলে আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো নিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে আমরা হয়তো আনসিভিলাইজড (সভ্য নয়) হিসেবে পরিচিত হব। ‘ডান্ডাবেড়ি নিয়েই বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি নজরে আনা হলে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত সোমবার এ মন্তব্য করেন। গত রবিবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি নজরে এনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার আরজি জানান আইনজীবী কায়সার কামাল। আদালত বলেন, ‘আমরা দেখেছি।’ তখন কায়সার কামাল বলেন, একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্র দিন দিন নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করছে। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়েছি। বেঞ্চ আদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি প্রক্রিয়া বজায় রাখার আগে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করতে বলেছেন। পটুয়াখালীর ওই ঘটনা নিয়ে চলতি সপ্তাহে নতুন করে রিট আবেদন করা হবে।’

সেদিন যা ঘটেছিলো, যে কারনে এত সমালোচনা: স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গত ১৯শে ডিসেম্বর গভির রাতে মো. নাজমুল মৃধাকে তার বাড়ি থেকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাকে একটি পুরাতন বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠায় আদালত। গত শুক্রবার রাতে নাজমুলের পিতা মোতালেব হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশালের একটি হাসপাতালে মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নিতে আইনজীবীর মাধ্যমে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করে নাজমুলের পরিবার। পরে তাকে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন আদালত। যে কারণে জানাজার নির্ধারিত সময়ের আগেই সংক্ষিপ্ত একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পিতা মোতালেব হোসেনের। প্রথম জানাজায় অংশগ্রহণ শেষেই পটুয়াখালী কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় নাজমুলকে। পরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয় তার পিতার মরদেহ। গত শনিবার মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী গ্রামে জানাজায় অংশ নেন নাজমুল। সেই জানাজায় অংশ নেওয়ার কিছু ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায়ই জানাজায় অংশ নেন ঐ যুবক। এসময় তার হাতকড়া খুলে দেয়া হলেও ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। ডান্ডাবেড়ি পরে জানাজায় অংশগ্রহণ করেও বাবার কবরে এক টুকরো মাটি দিতে পারেনি ওই ছাত্রদল নেতা। যার ফলেই দেশজুড়ে ঘটনাটি ঘিরে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

সাংবিধানিক আইন, বিধি ও আইনজীবীদের মতামত: ডান্ডাবেড়ি কোন ধরনের আসামীদের কেনো পরানো হয়, এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন ও বিধান নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন হাইকোর্টের একাধিক আইনজীবী তাদের জানানো মতামত অনুযায়ী (ডান্ডাবেড়ি যাদের পরানো হয়)— বাংলাদেশ জেল কোডের ১৯ নম্বর অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী কারাগারের অভ্যন্তরে ‘কারা অপরাধের’ জন্য গুরুতর শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানোর আদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে তবে এই শাস্তি আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিচারাধীন মামলার আসামি বা রাজবন্দীদের এ ধরনের দণ্ড দেয়ার কোনও বিধান নেই। জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ খেয়াল খুশিমতো বিচারাধীন বন্দি এবং আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরালে তা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন হবে বলেও জানাচ্ছেন আইনজীবীরা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আইনজীবীরা আরো জানান, আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতীত কাউকে কোনও ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না। আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, যে সমস্ত আসামিদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা শৃঙ্খলা জড়িত এবং যাদের মুভমেন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ আছে এবং যারা ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’, অর্থাৎ সুযোগ পেলে পালিয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রেই কেবল ডান্ডাবেড়ি পরাতে হয়। পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন,‘পটুয়াখালীর এই ঘটনাটি মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও ঘৃণিত এবং তাকে সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবেও চরম হেনস্থা করা হয়েছে। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।’
আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন,‘খুব যদি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী থাকে। তাদের জন্য ডান্ডাবেড়ি ছাড়া উপায় থাকে না। যাদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের এলিগেশন থাকে তাদেরকে ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়। তবে সেই ক্ষেত্রেও মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন,‘যে ফৌজদারি আইন আছে, সেটা হয়েছিলো সিপাহী বিদ্রোহের পরে। লক্ষ্য ছিলো সিপাহীদের দমন করা, এবং ভারতীয়দের সোজা রাস্তায় রাখা।’ তিনি আরো বলেন, এত বছর পরও সেই আইন এখনো প্রচলিত আছে এবং যারা আইন প্রণেতা হয়েছেন তারা যে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে সচেতন নন এবং এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেন নাই এটা দু:খজনক।

যা বললেন পরিবার: ছাত্রদল নেতা নাজমুলের বড় ভাই রাসেল মৃধা বলেন, নাজমুল এমন কোনো মামলার দন্ডপ্রাপ্ত আসামী না যে তাকে বাবার জানাজা পড়াকালীন ডান্ডবেড়ি পরিয়ে রাখা হবে। তাছাড়া তাকে যে মামলায় আসামী করে গ্রেফতার করে জেলা হাজতে পাঠানো হয়েছে তার সাথে নাজমুলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুধু বিএনপির রাজনীতি করি বলেই আজ এমন মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে হলো, বাবার কবরে এক টুকরো মাটিও দিতে পারেনি ছোটভাই নাজমুল। তার আগেই তাকে আবার জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। নাজমুলকে জাতীয় নিবার্চনের কয়েকদিন আগে গভীর রাতে পুলিশ বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জানতে চাইলে পুলিশ বলেন উপরের নির্দেশ। এ ঘটনার পরই বাবা বেশি অসুস্থ হয়ে পরে। আমার বাবাও বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল করা কি অপরাধ? আমরা তো রাজনীতি করি, সন্ত্রাস না। ছাত্রদল নেতা নাজমুলের মা রেবা বেগম বলেন, স্বামী কবরে, ছোট ছেলেটা জেলে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিবা হতে পারে। একজন মা জানে এটি কতটা কষ্টের। স্বামীর জানাজায় ছেলে আসলো তাও লোহার ডান্ডবেড়ি পরা। এমনকি দাফনের আগেই আবার ছেলেটাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবার কবরে এক টুকরো মাটিও দিতে পারলো না ছেলেটা। এ কেমন নোংরা রাজনীতির খেলা, এ কেমন আইন।
পটুয়াখালী পুলিশ সুপার সাইদুল ইসলাম বলেন,‘জেলখানা থেকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থাতেই দেওয়া হয়েছিলো। ওটার চাবি বা লক সিস্টেম সেটা আমাদের কাছে কখনোই থাকে না। এটা থাকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। ওরা যেভাবে আমাদের কাছে দিয়েছে সেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধুমাত্র নিরাপত্তা দেয়া। আমরা শুধু সেই নিরাপত্তাই দিয়েছি। ওরা আমাদের যেভাবে দিয়েছে, তাকে সেভাবেই পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।