ঢাকা , শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার সাথে একাধিক ছবিই ক্ষমতার হাতিয়ার:ভুয়া প্রকল্প ও প্রদর্শনীতে হরিলুট

  • প্রতিবেদক:
  • আপডেট টাইম ০৯:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
  • ১৭ ভিউ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছেন বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ।

নিরক্ষর কৃষকের জাল স্বাক্ষর ◾বিতরণ করা কৃষিযন্ত্র পুনরায় বিক্রি ◾ওয়েবসাইট থেকে তথ্য গায়েব

দুই ডজনখানেক প্রকল্প ও প্রদর্শনীর কোনো কাজ না করেই বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ বরগুনার বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদের বিরুদ্ধে। নিজস্ব ক্ষমতায় সকল নীয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক বাস্তবায়ন করেন ওই কৃষি কর্মকর্তা। যা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর বেতাগী উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন তানজিলা আহমেদ। সংশ্লিষ্ট একটি  সূত্র  জানায়, যোগদানের পর বছর ঘুরতেই এ পর্যন্ত কৃষিখাত থেকে আর্থিক হরিলুটের পরিমান কয়েক কোটি টাকা। সূত্রটি আরো জানায়, নিরক্ষর কৃষকদের স্বাক্ষর জাল, বরাদ্দকৃত কৃষিযন্ত্রপাতি অন্যত্র বিক্রি ও অস্তিত্বহীন প্রদর্শনীর মাধ্যমেই আকাশচুম্বী দুর্নীতি করেছেন তিনি। এদিকে, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নিজস্ব ফেইসবুক আইডিতে বারংবার সেয়ার করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তোলা বেশ কয়েকটি ছবি, যা ছিলো ক্ষমতার একমাত্র হাতিয়ার। এসব অনিয়ম দুর্নীতির অফিসিয়াল মাষ্টারমাইন্ড কৃষি কর্মকর্তা নিজে হলেও অফিসের বাহিরটা নিয়ন্ত্রণ করেন উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মো. হারুন অর রশীদ ও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লিমা আক্তার । যদিও আর্থিক হরিলুটের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান ওই দুই অফিসার। এক প্রকার প্রান্তিক কৃষকদের কাগজে কলমে জিম্মি করে উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও পৌরশহরে কৃষিখাতে একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন ওই কৃষি কর্মকর্তা। তবে এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তানজিলা আহমেদ, এদিকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন বেতাগী উপজেলা প্রশাসন।

জাল স্বাক্ষর ও অস্তিত্বহীন প্রদর্শনীর নামে হরিলুট: প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত প্রান্তিক শতাধিক কৃষকদের নিয়ে গড়া প্রদর্শনীর অস্তিত্ব দূরে থাক কৃষকদের প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেয়া হয়নি, অথচ উত্তোলন করা হয়েছে একাধিক প্রশিক্ষন ভাতার অর্থ তবে এসব বরদ্দের বিষয়ে কিছুই জানেন না অধিকাংশ কৃষক। বেতাগী উপজেলায় তালিকাভুক্ত প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি। কৃষকদের বক্তব্য তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব অর্থ লোপাট হয়েছে। এদের মধ্যে বেতাগী উপজেলার (আয়নাল সিকদার,আলতাফ হাওলাদার,জব্বার সিকদার,তৈয়ব আলীসহ) একাধিক কৃষক বলেন, তারা নিরক্ষর, কোনোদিন কলম ধরে স্বাক্ষর দেননি তারা। কোথাও স্বাক্ষর থাকলে সেটি টিপসই হবে, কিন্তু স্বাক্ষর কিভাবে আসলো তা তারা জানেন না। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেয়া তথ্যমতে কৃষকদের জাল স্বাক্ষরের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মো. হারুন অর রশীদ ও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লিমা আক্তার সম্পন্ন করেন। সূত্রটি আরো বলেন, এই কাজের জন্য লিমা আক্তার ও হারুণ অর রশিদকে আলাদা করে মাসিক ভাতা দেন কৃষি কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটির তথ্যনুযায়ী ২০২৩-২৪ ও ২৪-২৫ অর্থ বছরে রবি,আউশ ও আমনের প্রদর্শনী বাবদ বিভিন্ন প্রকল্প ও রাজস্বখাত থেকে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭১ হাজার ৩২৫ টাকা বিভিন্ন চেকে উত্তোলন করা হয়েছে। দু‘একটি প্রকল্প-প্রদর্শনী দৃশ্যমান হলেও, বাকি সব কাগজে কলমে ঠিক রেখে একই জমিতে একাধিকবার বিভিন্ন প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে শেষ করা হয়েছে কার্যক্রম। এমন প্রায় দুই ডজনখানেক প্রকল্প ও প্রদর্র্শনী থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দকৃত  অর্থ মোট ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা, এই দুই অর্থবছরেই ২ কোটি ৭৭ লক্ষ ৭১ হাজার টাকার হরিলুট হয়েছে শুধু প্রকল্প ও প্রদর্শনী থেকে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ কৃষকদের নানা সহায়তা প্রদানে উৎকোচ গ্রহণের জন্য ব্যবহার করেন মোবাইল ব্যাংক একাউন্ট। বিশ^স্ত সূত্রে ওই মোবাইল ব্যাংক একাউন্টের ট্রানজেকশন আইডি দ্বারা বিস্তারিত বিবরণি তথ্য সংগ্রহ করলে দেখা যায় গত এক বছরে ওই মোবাইল একাউন্ট থেকে লেনদেনের পরিমান ১৪ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়াও আনুসাঙ্গিক খাতের অর্থ মাসিক বেতনের মতো উত্তোলন করেন তিনি। ওই অফিসের একটি সংশ্লিষ্ট সূত্র এ বিষয়গুলি নিশ্চিত করেন।

কৃষিযন্ত্র বিক্রি করেই কোটি টাকার ভাগ, ক্ষমতার হাতিয়ার শেখ হাসিনার সাথে তোলা ছবি: গত ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিতরণ করা হয় ২টি কম্বাইন হারবেষ্টর মেশিন, ২১টি পাওয়ার থ্রেসার, ১৯টি সিডার। বেতাগী উপজেলায় বরাদ্দকৃত মোট ৪২ টি যন্ত্রে সরকারের ভর্তুকি ও কৃষকদের অর্থ মিলিয়ে  মোট ৭৮ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৭ টাকার আধুনিক কৃষিযন্ত্র ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের ভর্তুকি বাবদ,বাকি ৩০ শতাংশ কৃষকদের। তবে কৃষকদের মাঠে এসব যন্ত্রের কোনো হদিস নেই। এসব মেশিন একটি মাষ্টার মাইন্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হলেও কিছুদিন পরে কৃষি কর্মকর্তার যোগসাজসে কারসাজি করে ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেই পুণরায় বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে কিছু যন্ত্র বেতাগী উপজেলায় আছে তবে বাস্তবে সেগুলিও বিক্রিত। সদ্য এমন সরকারি কৃষিযন্ত্র (কম্বাইন হারবেষ্টর) চুরি করে বিক্রির সত্যতা পাওয়ায় তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছেন বেতাগী উপজেলা প্রশাসন। এসবের মধ্যে কয়েকটি সিডারের অস্তিত্ব মিললেও অস্তিত্বহীন কৃষিযন্ত্রের মূল্যই  অর্ধ কোটি টাকার ওপরে যা পুরোটাই আত্মসাত করা হয়েছে। এ যেনো কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নামে পুকুর চুরি এমনটাই বলছেন স্থানীয় সচেতন মহল। এছাড়াও জাতীয় তথ্য বাতায়ন ওয়েবসাইট (বেতাগী উপজেলা কৃষি অফিস) থেকে আপলোডকৃত ফাইলসহ (বরাদ্দ সংক্রান্ত পিডিএফ ফাইল ও নোটিশ) উন্মুক্ত সকল তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নতুনভাবে হালনাগাদ করে বিগত ৩ বছরের এসকল তথ্য গায়েব করা হয়।  

এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নিজস্ব ক্ষমতার দাপটে রাখতেন ওই কর্মকর্তা। আ.লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তোলা বেশ কয়েকটি ছবিই ছিলো তানজিলার ক্ষমতার বড় হাতিয়ার। নিজ ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ওই ছবি শেয়ার দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার জানান দিতেন কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা। ফলে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কখনো কথা বলতেন না বলেও জানা যায়। তবে ছবির বিষয়ে তানজিলা আহমেদের মতামত ভিন্ন তিনি জানান, শেখ হাসিনার সাথে তোলা ছবি ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে এওয়ার্ড প্রাপ্তির ও চাকরিতে  যোগদানের পর ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষনে মেধা তালিকায় স্থান প্রপ্তির সময়ে তোলা। এসব ছবি ফেইসবুকে ব্যবহার করে আমি কোনো প্রকার ক্ষমতার দাপট দেখাইনি।

সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ বলেন,‘ তালিকাভুক্ত কৃষক ছাড়া আমরা কাউকে কৃষি উপকরণ কিংবা সার,বীজ দেই না। একপর্যায়ে ভুয়া প্রকল্প, অস্তিত্বহীন প্রদর্শনী, মাষ্টাররোল ও কৃষকের জাল স্বাক্ষরসহ নানাভাবে অর্থ আত্মসাতের  অভিযোগগুলি সত্য নয় বলে নিজের পক্ষে সাফাই গান তিনি । এছাড়াও প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব দিলে, প্রতিবেদক রাজি না হলে সংবাদ প্রকাশ করলে মামলার হুমকি দেন তানজিলা আহমেদ।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন,‘ কৃষি অফিস সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছি, কিছুদিন পূর্বে একটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে সম্পৃক্তদের লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করেছি, সদ্য ধান মারাইকল, সেচ মেশিন, ও ট্রাক্টর অন্যত্র বিক্রির অভিযোগসহ ও মালামালের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে, যার তদন্ত চলছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই, কেননা এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি কখনোই পাইনি। স্বাক্ষাতকারের এক পর্যায়ে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, গত এক বছরে আমি কৃষি প্রণোদনার  ‘দুই কোটি’ টাকার বেশি পরিমান মূল্যের চেকে স্বাক্ষর করেছি। সকল অভিযোগের বিষয়ে  তদন্ত কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবগতির জন্য পাঠানো হবে।

ট্যাগ

মন্তব করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল

শেখ হাসিনার সাথে একাধিক ছবিই ক্ষমতার হাতিয়ার:ভুয়া প্রকল্প ও প্রদর্শনীতে হরিলুট

আপডেট টাইম ০৯:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

নিরক্ষর কৃষকের জাল স্বাক্ষর ◾বিতরণ করা কৃষিযন্ত্র পুনরায় বিক্রি ◾ওয়েবসাইট থেকে তথ্য গায়েব

দুই ডজনখানেক প্রকল্প ও প্রদর্শনীর কোনো কাজ না করেই বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ বরগুনার বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদের বিরুদ্ধে। নিজস্ব ক্ষমতায় সকল নীয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক বাস্তবায়ন করেন ওই কৃষি কর্মকর্তা। যা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর বেতাগী উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন তানজিলা আহমেদ। সংশ্লিষ্ট একটি  সূত্র  জানায়, যোগদানের পর বছর ঘুরতেই এ পর্যন্ত কৃষিখাত থেকে আর্থিক হরিলুটের পরিমান কয়েক কোটি টাকা। সূত্রটি আরো জানায়, নিরক্ষর কৃষকদের স্বাক্ষর জাল, বরাদ্দকৃত কৃষিযন্ত্রপাতি অন্যত্র বিক্রি ও অস্তিত্বহীন প্রদর্শনীর মাধ্যমেই আকাশচুম্বী দুর্নীতি করেছেন তিনি। এদিকে, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নিজস্ব ফেইসবুক আইডিতে বারংবার সেয়ার করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তোলা বেশ কয়েকটি ছবি, যা ছিলো ক্ষমতার একমাত্র হাতিয়ার। এসব অনিয়ম দুর্নীতির অফিসিয়াল মাষ্টারমাইন্ড কৃষি কর্মকর্তা নিজে হলেও অফিসের বাহিরটা নিয়ন্ত্রণ করেন উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মো. হারুন অর রশীদ ও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লিমা আক্তার । যদিও আর্থিক হরিলুটের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান ওই দুই অফিসার। এক প্রকার প্রান্তিক কৃষকদের কাগজে কলমে জিম্মি করে উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও পৌরশহরে কৃষিখাতে একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন ওই কৃষি কর্মকর্তা। তবে এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তানজিলা আহমেদ, এদিকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন বেতাগী উপজেলা প্রশাসন।

জাল স্বাক্ষর ও অস্তিত্বহীন প্রদর্শনীর নামে হরিলুট: প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত প্রান্তিক শতাধিক কৃষকদের নিয়ে গড়া প্রদর্শনীর অস্তিত্ব দূরে থাক কৃষকদের প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেয়া হয়নি, অথচ উত্তোলন করা হয়েছে একাধিক প্রশিক্ষন ভাতার অর্থ তবে এসব বরদ্দের বিষয়ে কিছুই জানেন না অধিকাংশ কৃষক। বেতাগী উপজেলায় তালিকাভুক্ত প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি। কৃষকদের বক্তব্য তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব অর্থ লোপাট হয়েছে। এদের মধ্যে বেতাগী উপজেলার (আয়নাল সিকদার,আলতাফ হাওলাদার,জব্বার সিকদার,তৈয়ব আলীসহ) একাধিক কৃষক বলেন, তারা নিরক্ষর, কোনোদিন কলম ধরে স্বাক্ষর দেননি তারা। কোথাও স্বাক্ষর থাকলে সেটি টিপসই হবে, কিন্তু স্বাক্ষর কিভাবে আসলো তা তারা জানেন না। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেয়া তথ্যমতে কৃষকদের জাল স্বাক্ষরের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মো. হারুন অর রশীদ ও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লিমা আক্তার সম্পন্ন করেন। সূত্রটি আরো বলেন, এই কাজের জন্য লিমা আক্তার ও হারুণ অর রশিদকে আলাদা করে মাসিক ভাতা দেন কৃষি কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটির তথ্যনুযায়ী ২০২৩-২৪ ও ২৪-২৫ অর্থ বছরে রবি,আউশ ও আমনের প্রদর্শনী বাবদ বিভিন্ন প্রকল্প ও রাজস্বখাত থেকে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭১ হাজার ৩২৫ টাকা বিভিন্ন চেকে উত্তোলন করা হয়েছে। দু‘একটি প্রকল্প-প্রদর্শনী দৃশ্যমান হলেও, বাকি সব কাগজে কলমে ঠিক রেখে একই জমিতে একাধিকবার বিভিন্ন প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে শেষ করা হয়েছে কার্যক্রম। এমন প্রায় দুই ডজনখানেক প্রকল্প ও প্রদর্র্শনী থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দকৃত  অর্থ মোট ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা, এই দুই অর্থবছরেই ২ কোটি ৭৭ লক্ষ ৭১ হাজার টাকার হরিলুট হয়েছে শুধু প্রকল্প ও প্রদর্শনী থেকে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ কৃষকদের নানা সহায়তা প্রদানে উৎকোচ গ্রহণের জন্য ব্যবহার করেন মোবাইল ব্যাংক একাউন্ট। বিশ^স্ত সূত্রে ওই মোবাইল ব্যাংক একাউন্টের ট্রানজেকশন আইডি দ্বারা বিস্তারিত বিবরণি তথ্য সংগ্রহ করলে দেখা যায় গত এক বছরে ওই মোবাইল একাউন্ট থেকে লেনদেনের পরিমান ১৪ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়াও আনুসাঙ্গিক খাতের অর্থ মাসিক বেতনের মতো উত্তোলন করেন তিনি। ওই অফিসের একটি সংশ্লিষ্ট সূত্র এ বিষয়গুলি নিশ্চিত করেন।

কৃষিযন্ত্র বিক্রি করেই কোটি টাকার ভাগ, ক্ষমতার হাতিয়ার শেখ হাসিনার সাথে তোলা ছবি: গত ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিতরণ করা হয় ২টি কম্বাইন হারবেষ্টর মেশিন, ২১টি পাওয়ার থ্রেসার, ১৯টি সিডার। বেতাগী উপজেলায় বরাদ্দকৃত মোট ৪২ টি যন্ত্রে সরকারের ভর্তুকি ও কৃষকদের অর্থ মিলিয়ে  মোট ৭৮ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৭ টাকার আধুনিক কৃষিযন্ত্র ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের ভর্তুকি বাবদ,বাকি ৩০ শতাংশ কৃষকদের। তবে কৃষকদের মাঠে এসব যন্ত্রের কোনো হদিস নেই। এসব মেশিন একটি মাষ্টার মাইন্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হলেও কিছুদিন পরে কৃষি কর্মকর্তার যোগসাজসে কারসাজি করে ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেই পুণরায় বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে কিছু যন্ত্র বেতাগী উপজেলায় আছে তবে বাস্তবে সেগুলিও বিক্রিত। সদ্য এমন সরকারি কৃষিযন্ত্র (কম্বাইন হারবেষ্টর) চুরি করে বিক্রির সত্যতা পাওয়ায় তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছেন বেতাগী উপজেলা প্রশাসন। এসবের মধ্যে কয়েকটি সিডারের অস্তিত্ব মিললেও অস্তিত্বহীন কৃষিযন্ত্রের মূল্যই  অর্ধ কোটি টাকার ওপরে যা পুরোটাই আত্মসাত করা হয়েছে। এ যেনো কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নামে পুকুর চুরি এমনটাই বলছেন স্থানীয় সচেতন মহল। এছাড়াও জাতীয় তথ্য বাতায়ন ওয়েবসাইট (বেতাগী উপজেলা কৃষি অফিস) থেকে আপলোডকৃত ফাইলসহ (বরাদ্দ সংক্রান্ত পিডিএফ ফাইল ও নোটিশ) উন্মুক্ত সকল তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নতুনভাবে হালনাগাদ করে বিগত ৩ বছরের এসকল তথ্য গায়েব করা হয়।  

এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নিজস্ব ক্ষমতার দাপটে রাখতেন ওই কর্মকর্তা। আ.লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তোলা বেশ কয়েকটি ছবিই ছিলো তানজিলার ক্ষমতার বড় হাতিয়ার। নিজ ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ওই ছবি শেয়ার দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার জানান দিতেন কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা। ফলে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কখনো কথা বলতেন না বলেও জানা যায়। তবে ছবির বিষয়ে তানজিলা আহমেদের মতামত ভিন্ন তিনি জানান, শেখ হাসিনার সাথে তোলা ছবি ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে এওয়ার্ড প্রাপ্তির ও চাকরিতে  যোগদানের পর ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষনে মেধা তালিকায় স্থান প্রপ্তির সময়ে তোলা। এসব ছবি ফেইসবুকে ব্যবহার করে আমি কোনো প্রকার ক্ষমতার দাপট দেখাইনি।

সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ বলেন,‘ তালিকাভুক্ত কৃষক ছাড়া আমরা কাউকে কৃষি উপকরণ কিংবা সার,বীজ দেই না। একপর্যায়ে ভুয়া প্রকল্প, অস্তিত্বহীন প্রদর্শনী, মাষ্টাররোল ও কৃষকের জাল স্বাক্ষরসহ নানাভাবে অর্থ আত্মসাতের  অভিযোগগুলি সত্য নয় বলে নিজের পক্ষে সাফাই গান তিনি । এছাড়াও প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব দিলে, প্রতিবেদক রাজি না হলে সংবাদ প্রকাশ করলে মামলার হুমকি দেন তানজিলা আহমেদ।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন,‘ কৃষি অফিস সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছি, কিছুদিন পূর্বে একটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে সম্পৃক্তদের লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করেছি, সদ্য ধান মারাইকল, সেচ মেশিন, ও ট্রাক্টর অন্যত্র বিক্রির অভিযোগসহ ও মালামালের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে, যার তদন্ত চলছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই, কেননা এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি কখনোই পাইনি। স্বাক্ষাতকারের এক পর্যায়ে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, গত এক বছরে আমি কৃষি প্রণোদনার  ‘দুই কোটি’ টাকার বেশি পরিমান মূল্যের চেকে স্বাক্ষর করেছি। সকল অভিযোগের বিষয়ে  তদন্ত কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবগতির জন্য পাঠানো হবে।