বেতাগীতে অপহরণের পর ধর্ষণ
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ধুম্রজাল
অভিযুক্ত সকলেই আছেন জামিনে
বিশেষে প্রতিনিধি:
বরগুনার বেতাগীতে ধর্ষণের পর কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি কিশোরী । গত ৩০ অক্টোবর সোমবার দুপুরে বসতঘরের মেঝেতে কারো সাহায্য ছাড়াই সন্তান প্রসব করেন ওই কিশোরী। ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় মূল আসামীসহ জড়িত সকলেই আছেন জামিনে। এদিকে সন্তান প্রসবের পর একটি চক্র বিয়ের আশ্বাস দিয়ে কিশোরী ও তার বাবার স্বাক্ষর নিয়েছে একটি দলিলে। তবে সেই দলিলটি এখন কোথায়! বা সেটি দিয়ে কি করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই জানেন না তারা। গুঞ্জণ উঠেছে গণধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ও জড়িতদের মামলার চার্জশিট থেকে বাঁচাতে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কাজ করছে চক্রটি, ফলে কোর্টে চার্জশিট দাখিলেও বিলম্ব করছে পুলিশ। তবে পুলিশের দাবী ডিএনএ রিপোর্ট না পাওয়ার কারনেই আটকে আছে মামলার (তদন্ত প্রতিবেদন) চার্জশিট।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, জঙ্গলঘেরা ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোমের আলোতে একটি ছোট্ট কক্ষে চৌকিতে শুয়ে আছে এক অশীতিপর বৃদ্ধ, পাশেই রক্তপাতযুক্ত কাতর শরিরে তিনদিন বয়সী সন্তানের মুখপানে নিবার্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরী। এ যেনো এক মর্মান্তিকতার শ্রেষ্ঠ প্রতিচ্ছবি। ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী সন্তান প্রসবের পর এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলেও, এ ঘটনায় খোঁজ নেইনি কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসন, এমনকি নবজাতকের মা ও শিশুটি মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। কারন ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে কাজ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র, যা সম্পূর্ণই রহস্যময়। তবে ওই কিশোরীর বাবা জানান, ‘সন্তান প্রসবের পর অচেনা দু’জন লোক এসেছিলো, তাদেরকে বলেছে সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানের আসল বাবার সাথেই ওই কিশোরীকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে যাতে সন্তানটি পিতৃপরিচয় পায়, একইসাথে কিছু আর্থিক সাহায্যও করা হবে। কিন্তু কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে হবে এবং কিছুদিন গেলে পরিবেশ শান্ত হলে মামলাটা তুলে ফেলতে হবে। পরে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ভালোমন্দ না বুঝেই স্বাক্ষর দেন দলিরের মতো কয়েকটি কাগজে। পরে আর কেউ খোঁজ নেয়নি।’
যেভাবে ধর্ষণের শিকার হন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি কিশোরী: ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ নিখোঁজ হন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ওই কিশোরী। ৩১ মার্চ গভির রাতে স্থানীয়রা দেখতে পান ওই কিশোরীকে অপহরণের পর লুঙ্গি পরিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। বেতাগীতে এ নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পুলিশের তদন্তে সত্যতা মিললে পৌরসভার বাসিন্দা মৃত মতি খানের ছেলে মজিবুর রহমানকে একমাত্র আসামী করে মামলা করেন কিশোরীর বাবা। মামলার এক মাস পর ৪ এপ্রিল র্যাবের হাতে ঢাকায় গ্রেফতার হন প্রধান আসামী মজিবুর। প্রধান আসামীর জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাাবাদ করেন পুলিশ। ঘটনাটি নিয়ে নানা ধরণের ধুম্রজাল ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে আরো দুইজনকে আটক করে জেল হাজতে পাঠানো হয় এবং রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশ। তবে প্রভাবশালী একটি চক্রের ক্ষমতাবলে গণধর্ষণের ঘটনাটি চাপা পরে যায়। জড়িত একাধিক ব্যক্তি থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
মামলার চার্জশিট ও ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে ধুম্রজাল সাধারণত ধর্ষণ মামলায় (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড) আইন ডিএনএ ২০১৪ এর ১০নং আইন অনুযায়ী এবং এসআরও ২৮৬—আইন/২০১৮ অনুযায়ী ধর্ষিতা ও অভিযুক্তের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পর সবোর্চ্চ ৩—৩১ দিন সময় লাগে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেতে। তবে এই মামলায় ৮ মাসের দীর্ঘ সময় পার হলেও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন(চার্জশিট) কোর্টে দাখিল করেননি পুলিশ। স্থানীয়রা জানান,‘ ধর্ষণের শিকার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি কিশোরীর সন্তান প্রসবের পরপরই একটি চক্র যারা ঘটনায় জড়িত ছিলো তাদেরকে মামলার চার্জশিট থেকে বাঁচাতে, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন করছেন। এমনকি ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে কিশোরী ও তারা বৃদ্ধ বাবাকে। ফলে মামলার চার্জশিট প্রদানেও গড়িমসি করছেন পুলিশ। এদিকে মামলার প্রধান আসামী মজিবুর সহ সন্দেহভাজন গ্রেফতারকৃত সকলেই আছেন জামিনে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মর্কতা(এসআই) জিহাদ হাসান বলেন, ডিএনএ টেষ্টের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করেই মামলার চার্জশিট তৈরী করা হবে। এ ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরো বলেন, যখন মামলাটি রুজু হয় তখনি মেডিকেল টেষ্টের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই কিশোরী অন্তসত্বা ছিলেন। বেতাগী থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান,‘ সঠিকভাবে মামলাটির তদন্ত চলছে, ডিএনএ রিপোর্টের জন্য চার্জশিট তৈরী করতে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তার বিলম্ব হচ্ছে। তবে অতি শিগগির মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কোর্টে দাখিল করা হবে।’
ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা: ধর্ষণ মামলাটির তদন্ত চলাকালীন ফেইসবুকে নানা আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এসময়ে স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর কামাল হোসেন পল্টুর নামটিও ধর্ষণে সম্পৃক্ত করে লেখালেখি হয়। এছাড়াও দায়ের হওয়া ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী মজিবুর কাউন্সিলর পল্টুর বেশ ঘনিষ্ঠজন বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। ফলে ওই সময়ে কামাল হোসেন পল্টুর নামটি বেতাগীতে ‘টক অব দ্যা টাউনে’ পরিনত হয়। পরে এ ঘটনায় স্থানীয় আরেক কাউন্সিলর মন্নান হাওলাদারকে দায়ী করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন কাউন্সিলর পল্টু। যদিও এ ঘটনায় মন্নান হাওলাদার বলেন তার নিজস্ব ফেইসবুক আইডিটি, কে বা কারা হ্যাক করে এই পোষ্ট করেছে তা তিনি জানেন না। বর্তমানে কাউন্সিলর মান্নান হাওলাদারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ডিবির জিম্মায় রয়েছে। এদিকে কাউন্সিলর কামাল হোসেন পল্টুর দাবী পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাকে সমালোচিত করতে তাকে নিয়ে ফেইসবুকে বিরুপ মন্তব্য করেন কাউন্সিলর মন্নান হাওলাদার। ফলে তিনি আইনী সহায়তার জন্য মামলা করেছেন। তিনি আরো বলেন, ওই ধর্ষণের ঘটনায় আমার কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা নেই।
সন্তান জন্ম দেয়া কিশোরীর বৃদ্ধ বাবা বলেন,‘ আমার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি মেয়েটা সত্যিই সন্তানের মা হয়েছে, তবে কে ওই সন্তানের বাবা হবে তা অজানা, এ ঘটনার সাথে তো অনেকেই জড়িত। পল্টু কমিশনার সব জানেন, ও একটা পাঁজি। ওরে আমি জেল খাটাবো। পল্টু মজিবুরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনছেন। মেয়েটার শরিরে পচন ধরেছে, সন্তান জন্মের পর পারিনি একটু ভালো খাবারখেতে দিতে, পারিনি ডাক্তারের কাছে নিতে। সারাদিন থাকি ভয়ের মধ্যে, আমি নিজেই অসুস্থ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনা। সারাদিন থাকি ভয়ের মধ্যে, কখন কে আবার জানে মেরে ফেলবেন। তবে একটা কথা বলে যাচ্ছি এই দুনিয়ায় এর বিচার না হলেও পরকালে ঠিকই পাবো। এদিকে স্থানীয়রা জানান,‘ এর আগে অসহায় বৃদ্ধ ও তার কিশোরী মেয়েটি অন্যের গোয়ালঘরে বসবাস করতেন, পরে পৌরসভার মেয়র এবিএম গোলাম কবির একটি ঘর তুলে দেন। তখন শতশত উৎসুক লোকজন আসেন বাড়িতে। ওই সময়ে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি কিশোরী মেয়েটির দিকে কুদৃষ্টি পরে পৌরসভার বাসিন্দা মৃত মতি খানের ছেলে মজিবুর রহমানের। পরে পরিকল্পিতভাবে মেয়েটিকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন, পরে অপহরণ করে সংঘবদ্ধভাবে দুইদিন যাবৎ জোড়পূর্বক ধর্ষণ করা হয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ওই কিশোরীকে। এ ঘটনার সাথে স্থানীয় অনেক রাঘববোঁয়াল এবং জনপ্রতিনিধিও জড়িত আছে। যার ফলে এতটা সময় পার হলেও মামলার সঠিক তদন্ত ও বিচার আজও অসম্পন্ন।