দাতাদের স্বল্প সুদে ঋণ কমছে
ডেস্ক নিউজ:
দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নমনীয় (স্বল্প সুদে) ঋণ পাওয়ার অঙ্ক পর্যায়ক্রমে কমছে। এর বিকল্প হিসাবে সরকার নজর দিয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী (বাংলাদেশে বলপূর্বক বাহস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক) এবং হোস্ট কমিউনিটির (টেকনাফ-কক্সবাজার জেলার আদিবাসী) নামে ঋণকে। এ নিয়ে দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সর্বোচ্চ নেগোসিয়েশন করছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের আশ্বাস মিলেছে। আরও ৩০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে আলোচনা চলছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে। ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে তাদের জীবনমান ও অবকাঠামো উন্নয়নে।
যদিও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো ধরনের ঋণ না গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সে অবস্থানে পরিবর্তন আনছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার আদিবাসীদের জন্য ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। বৈঠকে তিনি বলেন, দেশে অবস্থানরত বিপুলসংখ্যক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের কারণে পরিবেশ, জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যে এবং বনাঞ্চলের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। সামগ্র বাংলাদেশকেই এর মূল্য দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো তাদের জন্য মানবিক সহায়তা দিচ্ছে। এরপরও সরকারকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, ‘ইতিঃপূর্বে টেকনাফ ও কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের এবং বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (এফডিএমএন) জন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে কোনো ধরনের ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু ঋণের তালিকায় নমনীয় ঋণের পরিমাণ কমছে। যে কারণে ডব্লিউএইচআর (উইনডো হোস্ট কমিউনিটিস অ্যান্ড রিফিউজিস) থেকে ঋণ গ্রহণ প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। মূলত ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। সে কারণেই নমনীয় ঋণ পাওয়ার অংশ কমে আসছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রমতে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদেশি ঋণের ৬৭ শতাংশই ছিল নমনীয়। কিন্তু ২০২০ সালে এটি ৫৯ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে নেওয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ১৭ শতাংশ ছিল বেশি সুদের। ২০২০ সাল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৩ শতাংশে। ইআরডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০২৬ সালে গিয়ে সস্তা ঋণের সুযোগ কমে নেমে আসবে ৪৬ শতাংশে। ২০৩১ সালে তা আরও কমে ২৫ শতাংশে। ঠিক এর বিপরীত অবস্থা হবে উচ্চ সুদহারের ঋণের ক্ষেত্রে; যেগুলোর সুদহার নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বাজারভিত্তিক বা ফ্লোটিং হিসাবে।
সূত্রমতে, রোহিঙ্গা এবং টেকনাফ কক্সবাজার বাসিন্দাদের জন্য ঋণ নেওয়ার বিষয়টি এরইমধ্যে বিশ্বব্যাংকের ডব্লিউএইচআরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে সংস্থাটি শুধু ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কোনো অনুদান দিতে রাজি হয়নি। কিন্তু পরে সংস্থার সঙ্গে নেগোসিয়েশনের পর ৩১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান এবং ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ হিসাবে দেওয়ার সম্মতি দিয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক। বৈঠকে রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতাদের (হোস্ট কমিউনিটি) জন্য ৭০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরমধ্যে ৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার রোহিঙ্গাদের জন্য, আর বাকি ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার রোহিঙ্গা আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের (টেকনাফ-কক্সবাজার বাসিন্দা) জন্য নমনীয় ঋণ। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৫৬ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে।
এদিকে নমনীয় ঋণের ঘাটতি থাকায় রোহিঙ্গা ও হোস্ট গোষ্ঠীর জন্য এডিবির সঙ্গেও ঋণ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এই ঋণ পাওয়া গেলে অসুবিধাগুলো দ্রুত সমাধান হবে, সংশ্লিষ্টদের উন্নয়নে ব্যয় করা যাবে। পাশাপাশি এই মুহূর্তে দেশের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি আছে। সে ঘাটতি কমিয়ে আনতে এই ঋণ সহায়তা করবে। মার্কিন ডলারের সংকটও কিছুটা কাটবে। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে এডিবি ২০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছিল রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান হিসাবে। তবে একটি বিষয় নজর রাখতে হবে, যে লক্ষ্যে ঋণ নেওয়া হবে সেখানেই যেন অর্থ ব্যয় হয়। তাহলে ঋণের উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঋণ নেওয়ার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের কারণে টেকনাফ, কক্সাবাজারের স্থায়ী অনেক বাসিন্দা বেকার হয়ে পড়ছেন। এই বেকারাত্ব ঘোচাতে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় যুুক্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু কক্সবাজারের পাশাপাশি সমগ্র চটগ্রাম বিভাগকে হোস্ট কমিউনিটি হিসাবে চিহ্নিত করে এরপর দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে যেসব প্রকল্পের বিপরীতে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে সেগুলো হচ্ছে-কক্সবাজার-ভাসানচরে স্ট্রিট লাইট, সোলার ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতায়ন প্রকল্প, কানেকটিং রাস্তা নির্মাণ এবং রাস্তা প্রস্তুত, মেরামত ও সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেকনাফে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ তৈরি, ভাসানচরে যাতায়াতের জন্য জেটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বাজার উন্নয়ন। এছাড়া ভাসানটেকে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, ক্লিনিকে সেবাদানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের স্বল্পমেয়াদে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি, মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ক্রয়, নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো নির্মাণ, রোহিঙ্গাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণে প্রকল্প ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এভাবে আরও ১০টি প্রকল্পের কথাও সেখানে আলোচনা হয়।