সৈয়দা জুয়েলী আক্তার মনিকা
দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। তবে এখনও এমন গ্রাম আছে, যেগুলোয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই।শিক্ষার মান নিয়ে আজকাল বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকের মতে, শিক্ষার মান আগ থেকে অনেক হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ প্রসার ঘটেছে। দেশে নিরক্ষরতা অনেক হ্রাস পেয়েছে।
বিদ্যামান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন লাখের মতো। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৬টি। অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার বেশ প্রসার ঘটেছে। বর্তামানে সরকার অনুমোদিত ৯৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আরও একটি সম্প্রতি অনুমোদন পেয়েছে।এক্ষেত্রে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ২৩টি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫টি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় কয়েক লাখ। ভিন্ন ধারায় মাদ্রাসা শিক্ষা নামে আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল শিক্ষা চালু রয়েছে; তাতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কয়েক লাখ। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমল থেকে একটি ইসলামি শিক্ষা বেসরকারিভাবে চালু রয়েছে। তাতে সরকার কওমি মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করে দিয়েছে। এই কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে।
প্রতি বছর দেখা যাচ্ছে অর্থের অভাবে বহু উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না। দেশে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সর্বপ্রথম পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ। এছাড়া ক্লাসরুম পাঠদান নিশ্চিত করা, উন্নত শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার মান কিছুটা হলেও উন্নত করা যাবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। শিক্ষা খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তবে এক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি।
বিভিন্ন সময় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সব সরকারই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। সর্বশেষ শিক্ষানীতি বর্তমান সরকার ২০১০ সালে প্রণয়ন করেছে। অনেকটা সবার সমর্থন পেয়েছে এই শিক্ষানীতি। সরকার শিক্ষানীতির আলোকে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার চেষ্টা করছে। আরও কিছু পদক্ষেপ নিলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও উন্নত ও কর্মমুখী জীবনঘনিষ্ঠ হবে বলে মনে করি।
শিক্ষা সাংবিধানিক অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষাকে নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সংবিধানে বিধান রাখা হয়েছে। শিক্ষ কোনো পণ্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাকে কোথাও কোথাও পণ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আমাদের সংবিধানে মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই প্রত্যয় আরও দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত শিক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। কনটেন্ট, ক্যাপাসিটি, কমিটমেন্ট এ তিনটি সমন্বয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ: দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয়, আধুনিকও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য স্বীকৃত কোনো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা মনে করছি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশন করা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক ইনস্টিটিউট দেশে নেই। মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান দেশে নেই। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশে হাজার হাজার রয়েছে। লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী কওমি মাদ্রাসায় পড়ছে। এসব কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়ার মতো জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার সব পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে ভালো শিক্ষক তৈরি হচ্ছে অনেক কম। তাই প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালো শিক্ষক তৈরির বিকল্প কোনো পথ নেই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সব পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি।
বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ জরুরি: দেশে প্রতি বছর সরকার বাজেট দিচ্ছে। দেশে মোট প্রবৃদ্ধির তুলনায় শিক্ষা খাতে বাজেট অনেক কম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিলে যে বিশাল বাজেট দেখানো হয়, তা আসলে শুভংকরের ফাঁকি। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। দেশে সাত হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ২০১০ সাল থেকে। নন-এমপিও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বল্প বেতনে, বিনা বেতনে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদানে অনুমতি দিয়েছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা উচিত। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য এ ইস্যুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। পেটে ভাত না থাকলে কীভাবে শিক্ষকরা যথাযথ পাঠদান করবেন। শিক্ষকদের ন্যূনতম এই চাহিদা পূরণ সাংবিধানিক অধিকার।
সব ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম আধুনিক: দেশে প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কারিকুলাম তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কারিকুলাম উন্নত দেশের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাবি করছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছাত্রছাত্রীরা কর্মজীবনে শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। অনেকের অভিযোগ, আমাদের দেশের শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ নেই। কর্মমুখী শিক্ষা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে জাপানের উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম আমরা দেখার চেষ্টা করতে পারি। জাপানে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার বাস্তব প্রসার ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে।
শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে: উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী কী শিখল, তা তার কাছ থেকে বের করে আনা হয়। মানসম্মত ফ্রেমওয়ার্ক, অধ্যয়নের বিষয়বস্তু ও নিরীক্ষা কমিটি সেখানে থাকে। কীভাবে শিখতে হবে, তা জানাই হচ্ছে শেখা বা লার্নিং। একজন শুধু প্রথম শ্রেণিতে পাস করলে ভালো শিক্ষক হতে পারে না। তাই আলাদা প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি দেখে আমাদের দেশের সব শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে মানসম্মত শিক্ষা আমাদের দেশে কঠিন হয়ে থাকবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিকতা: শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন নৈতিকতা, নিয়মনীতি, স্বচ্ছতা, যোগ্যতাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়োগে নৈতিকতা না থাকলে নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক কখনও পাওয়া যাবে না। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সরকার প্রাইমারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কলেজ শিক্ষক নিয়োগেও পরীক্ষা হচ্ছে। তবে হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগে পরীক্ষা নেই। হাইস্কুলে নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে চালু করা দরকার। এতে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য কমে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম অনুযায়ী করা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে নীতি ও নৈতিকতা অনেকে মানছেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হওয়ার কারণে মেধাবী, যোগ্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা ও নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা কারিকুলামে ব্যাপকভাবে আনতে হবে। তা না হলে নৈতিকতা সম্পন্ন, মূল্যবোধ সম্পন্ন যুব শক্তি তৈরি হবে না। আজকের বাংলাদেশে এখন এটি প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সৎ, যোগ্য, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের স্বল্পতা সবচেয়ে বেশি আমরা অনুভব করছি।
শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল: আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা হচ্ছেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা দিয়ে তো কখনও প্রথম শ্রেণির সচিব তৈরি করা যাবে না। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে আমাদের দেশের শিক্ষক নিয়োগ কোন পর্যায়ে হয়। যেমন ফিনল্যান্ডে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে যিনি চান, তাকে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে হবে। এরপর তাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স করতে হবে। তারপরই তিনি একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। আমাদের দেশে প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো করতে হবে। সবচেয়ে উঁচু স্তরে শিক্ষকদের কাঠামো হতে হবে। তবেই সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রী শিক্ষকতায় আসতে উৎসাহিত হবে। তখনই ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে। ভালো শিক্ষক হলে ভালো ছাত্রও তৈরি সহজ হবে। এ অবস্থা আনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি, শক্তিশালী প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সরকারকে তাই বাজেট বৃদ্ধির সুপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
বিকেন্দ্রীকরণ নীতিমালা: শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মানোন্নয়ন সবার আগে জরুরি। এ জন্য বিকেন্দ্রীয়করণ নীতিমালা লাগবে। কারণ প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে আমরা শিক্ষকদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারি না। তাদের শাস্তি দিতে পারি না। তাই এ-সংক্রান্ত নীতিমালাগুলো অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের হাতে না আসবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় এটা নিশ্চিত করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠান প্রধান ভুল করলে শাস্তি দেন এতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের ক্ষমতায়ন না করলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।
পরিবারকে শিক্ষার মূল করতে হবে : আমাদের পরিবার শিক্ষার মূল ভিত্তি। পরিবার থেকে আমরা শিখুন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকি। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেমযুক্ত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। এ জন্য প্রয়োজন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যৌথ মিশ্রস্ক্রিয়া। শিক্ষা কোনো যান্ত্রিক এবং ব্যবসায়িক উপকরণ নয়। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন কমিটমেন্ট, নার্সিং, প্রয়োজন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা। নীতিমালা দ্রুত পরিবর্তন করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাড়িতে সন্তানের জন্য অভিভাবকদের ও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশি টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দিকে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।
পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা বাদ দিতে হবে: শিক্ষাকে আমরা বর্তমানে পরীক্ষানির্ভর করে ফেলেছি। পঞ্চম শ্রেণি, অষ্ট্রম শ্রেণি, দশম শ্রেণি ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আমাদের পরীক্ষা চালু রয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা অবিলম্বে বাদ দেওয়া উচিত। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি পরীক্ষার কারণে কোচিং বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কচি মনে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই শিশুদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। পরীক্ষার চাপে ভীত হয়ে শিক্ষা গ্রহণে শিশু মনে আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে। বই-খাতার বোঝা শিশু মনকে আরও বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে। বই-খাতার সংখ্যা কমাতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা পদ্ধতি আধুনিক শিক্ষার উচ্চতর পদ্ধতি দ্রুত চালু করা দরকার। তাছাড়া একাধিক পরীক্ষা নেওয়ার কারণে কোটি কোটি টাকা অভিভাবক ও দেশের অপচয় হচ্ছে।
একমুখী শিক্ষা: দেশে বহু ধারায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। শিক্ষানীতি আলোকে দেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা। কিন্তু সরকার এখনও পুরো জাতিকে একই ধারায় শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় আনতে পারেনি। তাই দেশে চার শ্রেণির চিন্তা চেতনা নিয়ে যুবসমাজ তৈরি হচ্ছে। কেউ কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছে, কেউ কোনো চাকরির সংস্থান করতে পারছে না। বিশেষ করে আরবি শিক্ষা, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা দেশের মূল ধারার সঙ্গে অপরিচিত থাকার কারণে দেশের সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবসমাজ দেশে নিজেদের মেধাকে কাজে লাগাতে না পেরে তারা প্রায় সবাই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ও-লেবেল ও এ-লেবেল পাসকৃত অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। তাদের প্রায় ৯৯ শতাংশ আর দেশে ফিরে আসছে না। তাদের মেধা দেশের জন্য ব্যয় হচ্ছে না। তাই দেশ ধীরে ধীরে মেধা শূন্য হয়ে পড়ছে। সরকারের পঞ্চম পর্যায়ে তাই মেধার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। মেধাহীন ব্যক্তিরা সরকাার ও বেসরকারি বড় বড় দায়িত্বে নিয়োজিত হচ্ছে বটে, তবে উপযুক্ত কর্মফল দেশ পাবে না। দেশের উন্নত জীবনে পৌঁছার জন্য এসব মেধাবীদের দেশে ফিরে আনার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। দেশে প্রচুর পরিমাণে মেধাবীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। বেসরকারি খাতেও কীভাবে মেধাবীদের কর্মসংস্থান করা যায় তার কৌশল সরকার উদ্ভাবন করতে হবে। তবেই সুশিক্ষা, সুশাসন ও মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা ফিরে আসবে।
ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম মুক্ত শিক্ষা : দেশে এখন অনিয়মের বাণিজ্যে সয়লাব। সমাজের সর্বস্তরে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য বর্তমান ঘুষ, দুর্নীতি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতা, আদর্শ, সততা শিক্ষা দেবে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সর্বস্তরের ঘুষের, দুর্নীতির লেলিহান শিখা প্রবহমান। বিগত কয়েক বছর ধরে দুর্নীতির মাধ্যমে সর্বস্তরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এমনকি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির প্রশ্নপত্র পর্যন্ত ফাঁস হয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরোপুরি এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু অন্যায় যে করে তার বিচার ঠিকমতো হচ্ছে না। অন্যায়কারী নিয়মিত পুরস্কৃত হয়ে আরও বেশি গতিতে দুর্নীতি করার প্রয়াস পাচ্ছে। আইনের শাসনের অভাব এই ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। আইন ঠিকমতো পালন করা যাচ্ছে না বা পালন করতে অনীহা রয়েছে। কর্তাব্যক্তিদের এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। নিয়ম, আইন সবাইকে মানার জন্য বাধ্য করতে হবে। শাস্তির বিধান ঠিকমতো কার্যকর করাই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার একমাত্র কার্যকর উপায়।
[ সহকারী শিক্ষক, বেতাগী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেতাগী ]